আমার ছেলেবেলার গল্প

আমি সারাটি জীবন আমার মায়ের উপর এক অদ্ভুত রাগ নিয়ে বড় হয়েছি আমি। সেই রাগের কারণ পুরোপুরি অযৌক্তিক কি না জানি না, তবে খুব সামান্য হলেও যে খানিকটা যৌক্তিক, সে আমি জানতাম। সেই রাগের কারণ আমার বাবা। ছোটবেলায় রঙ্গিন স্বপ্নের ঝলমলে শৈশব। সেই শৈশবে বুকের গহীনজুড়ে না পাওয়ার তীব্রতম কষ্ট থাকে, আর থাকে প্রাপ্তির তীব্রতম আনন্দ! কিন্তু সেই তখন, আব্বার সাথে যখন দোকানে যেতাম, আম্মা তখন ফিসফিস করে আমার কানের কাছে বলে দিতেন, ‘বাবা, দোকানে গিয়ে কিন্তু তোমার আব্বার কাছে কিছু চাইও না, কিছু কিনে দিতে বলিওনা, কিছু চাইও না’।
আমি বলতাম, ‘কেন?
আম্মা বলতেন, ‘তোমার আব্বার কাছে যদি টাকা না থাকে? যদি তোমারে কিনে দিতে না পারেন? তখন তোমার আব্বায় অনেক কষ্ট পাইবেন না?’
আমি কোন কথা বলি না। আমার খুব কষ্ট হয়। বুকের ভেতর সেই কষ্ট ফোঁটা ফোঁটা চুইয়ে জমা হয়। জমা হয়ে গলা ভার হয়। কত কিছু চাইব ভেবে রেখেছিলাম, অথচ আম্মা…!
আম্মা আবার বললেন, ‘তোমার আব্বা কি তোমারে ভালোবাসে না?’
আমি মাথা নাড়িয়ে বলি, ‘হ্যা’।
আম্মা বললেন, ‘তোমার আব্বা তোমারে এই দুনিয়ার সবচাইতে বেশি ভালোবাসে। এখন যে তোমারে দুনিয়ার সবচাইতে বেশি ভালোবাসে, সে যদি তোমার কোন একটা ইচ্ছা পূরণ করতে না পারে, তাহলে তার কাছে কেমন লাগবে? খারাপ লাগবে না? খুব খারাপ লাগবে না?’

images

আমি কোন কথা বলি না। আমার ছোট্ট শিশু মন, সে এতো হিসেব নিকেশ বুঝতে চায় না। সে চায়, সে তার বাবার সাথে দোকানে যাবে, গিয়ে রঙ্গিন খেলনা কিনবে, পকেটভর্তি চকলেট কিনবে, নানান রঙের জিনিষ কিনবে। এতসব ভাবনা, হিসেব নিকেশ তার বুঝতে ইচ্ছে হয় না। তার বুঝতে ইচ্ছে হয় না, তাদের টানাটানির সংসার। তার বাবার আয় রোজগার কম, তার সামর্থ্য ভয়াবহরকম সীমিত। তার এসব কিছুই বুঝতে ইচ্ছে করে না, একদম না। তারও আর সকলের মত দোকানে গিয়ে বাবার কাছে রাজ্যের আবদার করতে ইচ্ছে করে।

কিন্তু আম্মা রোজ রোজ তার কানের কাছে ফিসফিস করে বলতেই থাকেন, ‘আব্বা যখন নিজে ইচ্ছে করে কিছু কিনে দিবে, তখন সেইটা নিও। তখন ভাবিও, আব্বার কাছে টাকা আছে। আর তুমি কিছু চাইলে, আর আব্বা দিতে পারল না, তখন আব্বা তোমার কাছে ছোট হইয়া যাইবে না? দোকানদারের কাছে ছোট হইয়া যাইবে না? অনেক কষ্ট পাইবেন না? তোমার আব্বা কষ্ট পাইলে, অন্য মানুষের কাছে ছোট হইলে কি তোমার ভালো লাগবে? লাগবে ভালো?’

আমি আবারও মাথা নাড়াই, আমার ভালো লাগবে না। আব্বা একবার দুকান থেকে পাইকারি দরে একবস্তা চাউল কিনেছেন। সেই চাউল ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু দোকান থেকে ঠেলাগাড়িতে আনতে অনেক পথ! এই পথ এক মণ ওজনের চাউলের বস্তা আনতে হবে কুলি ডেকে। কিন্তু কুলিকে দেয়ার টাকাটা আব্বা ব্যায় করতে চান না। তিনি সেই বস্তা নিজের মাথায় তুলে নিলেন, প্রায় আধা কিলোমিটার পথ তিনি সেই বস্তা মাথায় করে নিয়ে এলেন। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে ঠেলাগাড়িতে উঠাতে চাইলেন, উঠাতে যেতেই কুলিরা দলবল নিয়ে ছুটে এলো। কুলি ছাড়া মাল বহনের নাকি নিয়ম নেই। কিন্তু আব্বা! ওই ক’টা টাকাই তার কাছে অনেক কিছু। ওই ক’টা টাকায়ই তিনি আমাকে হোটেলে নিয়ে এক প্লেট পোলাও, আর সামান্য ভুনা তরকারির ডিম দিয়ে পোলাও খাওয়াতে পারবেন! আমার কতদিনের ইচ্ছে হোটেলে একবেলা ভাত খাবার। হয়তো সেইজন্যই আব্বা…

কিন্তু সেই আমার জন্য কুলিরা সকলের সামনে আব্বাকে কত কিছুই না বলল! কত সব পচা পচা কথা! সেসব শুনে সেই ছোট্ট আমার কেমন যে লাগল! কান্নায় গলা আঁটকে এলো। চোখ ঝাপসা হয়ে এলো। আমি আব্বার কানের কাছে ফিসফিস করে বললাম, ‘আব্বা, আমি হোটেলে ভাত খাইব না। আমার হোটেলের খাওয়া ভাল্লাগে না। কেমুন হলুদ দেয়া বেশি, ঝাল, আর গন্ধ…’

আব্বা আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। তার সেই চোখজুড়ে ছলছল নদী। কিন্তু তিনি সেই নদীতে বাঁধ দিয়ে রেখেছেন। আমার সামনে তিনি সেই নদীর বাঁধ ভাঙতে চান না। একদম না।

আমি চাই না, আমার জন্য আব্বাকে আর কেউ কিছু বলুক, ছোট করুক, আব্বা আমাকে কিছু না দিতে পেরে কষ্ট পাক, আমি চাই না। সেই শৈশব, স্বপ্নময় ইচ্ছের শৈশবে আম্মা আমাদের বুকের ভেতর এই বোধ ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন, রোজ রোজ বুঝিয়েছিলেন, বাবা মা সন্তানকে কিছু দিতে না পারলে কি প্রবল আক্ষেপ, কী অবর্ণনীয় কষ্ট তারা বুকে বয়ে বেড়ান। পুড়ে যান অহর্নিশ। দহনের দীর্ঘ দিবস রজনী! সেই কষ্টের যন্ত্রণার অন্তত খানিকটা হলেও যদি তার সন্তান বুঝতে পারে, খুব সামান্য হলেও। তবে তারচেয়ে আনন্দের আর কী আছে!

কিন্তু তখন আম্মার ওই কথা শুনে খুব অভিমান হত, রাগ হত, বিদ্রোহ হত।

এই অতিথের কষ্ট মনে হলে খানিক চুপ করে বসেতাকি। আঁতকে উঠি পরে ভেবে দেখি আজকালকার সন্তানদের অনেকেই না পাওয়ার কষ্ট সহ্য করতে পারেনা খুব ভয়ানক আচরণ খুব একটা বিরল কিছু নয়। আমাদের চারপাশে অহরহই এমন অজস্র ঘটনা দেখেছি, একটা স্মার্টফোন, একটা ল্যাপটপ, আইপ্যাড, দামী মোবাইল, পোশাক, পকেঠ খরচের টাকা, বাইক, ক্যামেরা, আরও কত কিছু! কতকিছুর জন্য তারা মা-বাবার উপর রাগ পুষে উচ্ছোবাচ্চো কথা বলে মা-বাবার সাথে।

এখনো মনে পড়ে ছোটবেলা দেখেছি সেই নানান কিছুতে বাবা মায়ের কান্না, আক্ষেপ, হতাশা লুকিয়ে লুকিয়ে ভেসে বেড়ায়। কিন্তু তাদের বুকের ভেতর একবারও কি ভেসে বেড়ায়, এই সন্তানদের শৈশবে আদরে আহ্লদে, বায়না পূরণে দিনের পর দিন তারা সীমানা ভেঙ্গেছেন! তাদের বোধের জায়গায় স্পর্শময়তা, সংবেদনশীলতার ক্ষমতা লুপ্ত করেছেন! সেই সন্তানদের কখনও বুঝতে দেননি, এর চেয়েও বেশি কিছু তারা তাদের বুকের ভেতর জমিয়ে রেখেছেন। সেই বেশি কিছুরা এই ঠুনকো প্রাপ্তির কাছে ক্রমশই আড়াল হয়ে গেছে, যাচ্ছে। বোধ! বোধের প্রগাঢ় স্পর্শ ক্রমশই বিলীন হয়ে গেছে। সেই বোধ স্পর্শ করবার ক্ষমতা তারা নিজেরাই নষ্ট করে দিয়েছেন, দিচ্ছেন।

আজ, আমার হঠাৎ, আমার মায়ের প্রতি সেই রাগ, সেই অভিমান, সেই ক্ষোভ, প্রবল ভালোবাসায় পরিণত হল, কৃতজ্ঞতায় পরিণত হল। কারণ তিনি আমাদের বোধ স্পর্শ করতে শিখিয়েছিলেন, সংবেদনশীল হতে শিখিয়েছিলেন, শিখিয়েছিলেন পরিমিতি বোধ। তিনি শিখিয়েছিলেন, জগতে কেবল আমার পাওয়ার, আকাঙ্ক্ষার ভাবনাই একমাত্র ভাবনা নয়, একমাত্র সত্য নয়। এর বাইরেই, এর চেয়ে মূল্যবান, এর চেয়ে গভীরতম অজস্র জিনিষ রয়েছে। সেইসকল কিছুর মধ্যে শ্রেষ্ঠতম হল ভালোবাসা। জগতের শ্রেষ্ঠতম মমতায়, আদরে, ঐশ্বর্যে মোড়ানো ভালোবাসা।

যে সন্তান সেই ভালোবাসার মূল্য বুঝবে, সেই সন্তান জানে, হয়তো একদিন পিতা হয়েও সে তার সন্তানদের ভেতর সেই ভালোবাসার মূল্য বোঝার বোধ ছড়িয়ে দিতে পারবে, স্পর্শ করতে পারবে, পারবেই।

Leave a comment